Sunday, October 17, 2021

বিসর্জনের আগে ও পরে দাবার গুটিগুলো এবং বাংলাদেশ


পরশুরাতে কুমিল্লা গিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম শহরে দুইনাম্বারের কাছে আসার পর ভাগিনী Mobile এ Call করে বলে, 'মদিনা মসজিদের কাছে গোলাগুলি হচ্ছে। আমরা জানালা সব বন্ধ করে রেখেছি। সাবধানে আইসো।' জীবনের এই পর্যায়ে এসে অন্তত এতটুকু বুঝেছি, মানুষ তার প্রিয়মানুষগুলোর জন্য সবসময় মঙ্গল কামনা করে। দোয়া পড়ে অলংকার থেকে তিশা বাসে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম৷ Spotify তে Xefer এর গান প্লে করে দিলাম। তার অল্প কয়েকটি গান ছাড়া খুব বেশি শোনা হয়নি। ভাবলাম, সব Collection শুনে ফেলি। ঠান্ডা বাতাস; Game of Thrones এর Dialogue টার কথা মনে হলো, 'Winter is coming.'

"..............
Memories
Restless childhood feelings
Now you deny my existence
Is this how you feel
........."
ফেনী থেকে কুমিল্লার সীমানায় বাস ঢুকতেই Spotify বন্ধ হয়ে যায়। No Internet. ছোটভাই ও দু'তিনজন বন্ধুকে Call করলাম শহরের পরিস্থিতি জানার জন্য। কেটে দিচ্ছে নতুবা ধরছে না। ১১ঃ৪৫ টায় টমসমব্রীজে নেমে অল্পকিছু দোকান খোলা পাই। ৭-৮ জন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। সচরাচর এই সময়ে ২ জনের বেশি থাকে না। আমার কর্মস্থলের নতুন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান Creative Nursing College Chattogram - CNCC এর বেশ কয়েকটি ব্যানার দেখলাম। টং দোকানে শহরের পরিস্থিতি জিজ্ঞাসা করলাম। দোকানদার বলল, 'কাকা, সারাদিন বন্ধ রাকছি, একটু আগে খুললাম।' একজন পুলিশ আমার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন। একটা অটোরিকশা নিয়ে রওয়ানা হলাম। ইঞ্জিন রিকশার সাউন্ডটা বিরক্তিকর, আর আমারও পরিবেশটা বিরক্তিকর লাগছে। হঠাৎ রিকশাওয়ালা বলল, 'ভাইয়া, আইজকা সারাদিন বেকার। কামাই-রোজগার কিছু অয় নাই।' কি জন্য যেন তার কথাটা বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলাম না। পাড়ার গলিতে চিরচেনা রূপ। কোন পার্থক্য ধরা পরছে না। একটা বাচ্চা সম্ভবত তার বাবার সাথে হাঁটতে বের হয়েছে। হাতে সবুজ আলোর লেজার লাইট। ইসমাঈল নানার বড় ভাইর বাসার তিনতলার দিকে তাক করে রশ্মি ছুঁড়ে মারছে। আমি গুরুজনদের মত ভাব নিয়ে, 'কিতাও, কি অইছে তোমার।' লাইট বন্ধ করে বাবার হাত আকঁড়ে ধরল। কিছুদিন আগে পত্রিকায় একটি খবর ছিল, 'বিমানের চলাচলে লেজার রশ্মির দৃষ্টিভ্রম নিয়ে কতৃপক্ষ কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না।' আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, কর্তৃপক্ষ কোনদিনও সমাধান খুঁজে পাবেও না। কেনো পাবে না তার উত্তরটা লেখার শেষে বলব। বাসার কাছে এসে রিকশাওয়ালাকে ১৫ টাকার পরিবর্তে ৩০ টাকা দেই। কিছুক্ষন ডাকাডাকির পর আম্মু দরজা খুললেন। পৃথিবীতে জান্নাতের প্রশান্তিটা আমার মা, স্ত্রী আর কন্যার মুখেই খুঁজে পাই। আম্মা উনার এক সহকর্মীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। আসার সময় আমি আসব শুনে উনি আম্মুর সাথে আমার জন্য খাবার দিয়ে দেন। আত্নার সাথে আত্নার হৃদ্ধতার সম্পর্কগুলো কিভাবে গড়ে উঠে এটা দুই আত্নার মাঝে বসবাস না করলে বোঝার সাধ্য কারোর নেই। খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষে আগামীদিন গ্রামের বাড়ি যাওয়ার Plan করি।
সকালে হালকা নাস্তা করে আমার ছোট খালার মেয়ে শিরিনকে দেখতে আম্মু কুমিল্লা টাওয়ারে যায়। আমি আমার বড় বোনের বাসায় যাই। যেতে যেতে সালাউদ্দিনের সামনে পূজার তোরনের ভঙ্গুর দশা নজরে পড়ে। ছবি তুলি। এখানে দিচ্ছি না । কারন সত্যমিথ্যা সহিংসতার খবর খালি আসছেই চারদিক থেকে। সকাল দশটার দিকে দেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। যেতে যেতে বাগমারা পুজামন্ডপের দিকে নজর পড়ে। দু'জন পুলিশ পাহারায় আছেন। ভিতরে কিছু লোক অলসভাবে বসে আছেন। বাড়িতে চাচা-চাচীদের সাথে জমি-জমা সংক্রান্ত কথাবার্তা হয়। ছোট চাচী আমাদের রান্না করে খাওয়ান। সেজো চাচী আম্মু ছোট মাছের তরকারি দেন। ভালোই লাগছিল, আপনজনের সাথে সময় কাটাতে পেরে।
শহর থেকে গ্রামে লোকজনের ভিতর মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে দুষছেন। আবার কেউ বিরোধীদলকে গায়েল করার অস্ত্র হিসেবে এটাকে দেখছেন। আমার বাসা থেকে দুই কিলোমিটারের মত দূরে নানুয়াদীঘির পূজামন্ডপ অবস্থিত যেখানে প্রতিমার পায়ের কাছে মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রাখা হয়েছিল। অভিযোগ যে, এরকম ঘটনা ঘটার পর পূজা বন্ধ করার জন্য বলা হয় যা তারা করতে চায়নি। আপনি আপনি Theory of Mind থেকে এই বিষয়টাকে বুঝার চেষ্টা করেন তাহলে ঘটনা অন্যভাবে চিন্তা করতে পারেন। মুসলিমদের পবিত্র ঈদ-উল-আযহার সময় গো-হত্যা থেকে অভিযোগ তুলে উৎসব বন্ধ করতে বলা হল। স্বভাবতই মুসলিমরা চাইবে তাদের পবিত্র উৎসব বন্ধ করতে। আর এজন্য আপনি তাদের উপর হামলে পড়লে সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হবয়ার শঙ্কাই বেশি। অনুভূতি মানবের বৈশিষ্ট্য, ভোঁতা অনুভূতি পশুদের বৈশিষ্ট্য। আমি কোরআন ও হাদিসে বিশেষজ্ঞ নই, তবে যতটুকু চর্চা করেছি ও বুঝেছি, ইসলাম সম্প্রীতি ও শান্তিতে বিশ্বাসী। কুমিল্লায় ঘটে যাওয়া ঘটনা ও পরবর্বতীতে চলমান ঘটনা এদেশে কলহ বাঁধানোর মাধ্যমে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ফয়দা লুটার একটা নিকৃষ্ট চেষ্টা এবং অনেকটা সফলও বটে। এখানে আবেগ ও বিবেককে গুলিয়ে ফেলে দাবার গুটি হয়ে যাওয়া মুসলিম ও হিন্দু ভাই-বোনদের জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।

কৌতুহল থেকে আমি জীবনে দুইতিনবারই পূজামন্ডপে ডুকেছি। আমার বেশকিছু স্কুল বন্ধু আছে যারা সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বী। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত তাদের অনেকের সাথেই সখ্যতা ছিল। এখনও কয়েকজনের সাথে আছে। কুমিল্লা মডার্ণ হাই স্কুলে চাকুরী সূত্রেও বেশ কয়েকজন হিন্দু সহকর্মী পেয়েছি। শুধু একবারই এক হিন্দু সহকর্মী থেকে ইসলাম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য পেয়েছিলাম। আমার কাছে ওটা বিদ্যালয়ের মাঝে রাজনীতির একটি অংশ থেকে বেশি কিছু মনে হয়নি। আর আমার যে শিক্ষকরা হিন্দু ধর্মালম্বী আমি ওদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ওরা ছিলেন বলেই, আমি ওতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি। দিলীপ স্যারের পেটের চিমটি আর কৃষ্ণ স্যারের রসায়নের সূত্রের মজা না পেলে কবেই হারিয়ে যেতাম।
বিকেলে কুমিল্লার বাসায় ফিরে আসলাম। আম্মুকে শাকতলার কাছে ডাক্তার জুয়েলে কাছে নিয়ে গেলাম। রুট ক্যানাল করাচ্ছেন। জুয়েল ছেলেটার ব্যবহার অমায়িক। আম্মু আমার কাছে প্রায়ই তার প্রশংসা করেন। মাগরিবের পর আম্মুকে নিয়ে বিশ্বরোড চলে গেলাম। আম্মু ফেনীতে ছোট বোনের বাসায় যাবেন আর আমি চট্টগ্রাম চলে যাব। তিশা বাসে রওয়ানা দিলাম। আম্মু ক্লান্ত শরীরে ঘুমাচ্ছেন। মহীপাল আসার পর আম্মুকে নামিয়ে আমি রওয়ানা দিলাম। হঠাৎ করে মোবাইলে ইন্টারনেট আসল আর সেই Notification এর Vibaration - It feels like --
".....Party in da getto
Inna da getto
Party in da getto
Inna da getto...."
পরের দিন। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে সহকর্মীর বিবাহের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলাম ২ঃ৪৫ টার দিকে। ডুকার পথে ৩৫ -৪০ বছরের একজন ভিক্ষা চাইলেন, না চাওয়ার ভান করে ডুকে পড়লাম। মাঝে মাঝে Ignore করার ধরনটা Rude হলেও প্রাণের দেশের Root System আমাদেরকে আপনা থেকেই স্বশিক্ষিত করে তুলে। অন্তত এই শিক্ষাটা নেশাখোরকে তার নেশার টাকা দেয়া থেকে আপনাকে বিরত রাখবে। বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার সবচেয়ে পছন্দের অংশটি হচ্ছে কব্জি ডুবিয়ে ভরপেট খাওয়া। চট্টগ্রামের ভিন্ন আইটেমের একটি হচ্ছে গরুর কালো ভুনা। এটা রান্না করার জন্য এখানে নাকি মাংসটি রোদে শুকিয়ে নেয়া হয়। রান্নাটা প্রশংসা করার মত ছিল।
Community Centre থেকে বের হয়ে সহকর্মীকে বিদায় দিয়ে Tempo বাহনে করে আগ্রাবাদ মোড়ে আসলাম। আগ্রাবাদ থেকে ৪ নাম্বার বাসে উঠলাম মুরাদপুরে যাওয়ার জন্য। আজ দূর্গাদেবীকে বিসর্জনের দিন। পুলিশ পাহরায় প্রতিমা নিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ট্রাক। আমার সাথে বেশ কিছু তরুন বসে আসে। ঠিক পিছনের একলোক ওদের উদ্দেশ্য করে একের পর এক গালি দিয়ে যাচ্ছেন। আর তরুনগুলো বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য করছেন।
কাঠমন্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হিন্দু শিক্ষক আমাকে একদিন বলেন, "Do you know, Arif? I often go to your mosque to pray. I find pleasure after praying there." আর আমরা এখানে কি বিষ ছড়িয়ে দিলাম! চারদিক থেকে সহিংসতার খবর আসছে।
একটি সুনাগরিক গড়ে তুলার দায়িত্ব বাবা-মা, শিক্ষক এবং অন্যান্য Stakeholders সবার উপরই বর্তায়। বাবা-মা সংসার চালানোর জন্য কর্মে এতটাই ব্যস্ত যে শিশুর কৈশড় কেড়ে নিচ্ছে। আবার এই দেশে এত এত প্রকারের বিদ্যালয় যে হিংসা-দ্বেষ এখান থেকেই রচনা হয়। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষককে বাধ্য হয়ে গ্রুপিং করতে হয়। শিক্ষকের গায়ে পিয়ন থেকে অভিভাবক, অভিভাবক থেকে আমলা, আমলা থেকে রাজনীতিবিদদের হাত তুলতে বাঁধে না। বিচারহীনতার শিকার শিক্ষকরা কি প্রজন্ম তৈরি করছে তার বোধ আমাদের হবার নয়।
একজন হিন্দু শিক্ষকের মন্তব্য পড়লাম, "তথাকথিত যে দেশে পবিত্র কোরআন কে অবমাননা করা হয় আর দেবী দুর্গার পবিত্র মূর্তি কে ভূপাতিত করা হয়, সেই চুলের দেশে থাকলামই না যাহ."
সমাজের প্রতিটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে বিচার ব্যবস্থায় সঠিক প্রয়োগ শুরু না হলে এদেশকে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন থেকেই যাবে। Sacred Games এ গায়তন্ডের একটা সংলাপ এরকম ছিল, " হিন্দু হোটেল থেকে আমি এটা শিখেছি যে, জনতাকে কতটুকু চু** বানানো যায়।" আজ অসুস্থ রাজনীতিতে সুযোগ সন্ধানী হাজার হাজার গায়তন্ডে শিখে গেছে, এদেশে হিন্দুদের ভাতের পাতে ভিতর গরু্র মাংস লুকিয়ে দিলে আর মুসলমানের ভাতের পাতে শুকুর লুকিয়ে দিলে রক্তের বন্যা বয়ে দেয়া যায়।
শুরুতে লেজার রশ্মি নিয়ে বিমানের সমাধান না খুঁজে পাওয়ার উত্তর খুঁজে দিব জানিয়েছিলাম। চট্টগ্রামের ভাষায় একটা অশ্লীল প্রবাদ থেকে উত্তর বুঝে নিবেন, আশা করি,
"পুন্দত নাই তেনা, মিড়ে দি ভাত খানা।"
আমি পরবর্তিতে কুমিল্লা গিয়ে অন্তত একজন হিন্দু বন্ধুর সাথে দেখা করব। আতঙ্ক দূর করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আপনারা সবার জায়গা থেকে নিজ হিন্দু বন্ধু, সহকর্মী ও প্রতিবেশীর সাথে যোগাযোগ করুন, সহমর্মিতা জানান।

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment.